Monday, April 25, 2022

নায়িকার আগে ছিলেন মানবতাবাদী জুলাই ১, ২০২১ | অভীক চট্টোপাধ্যায়

 ছবির নায়িকা বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, অনেক অভিনেত্রীকেই হয়তো পুরোপুরি তার সঙ্গে মেলানো যায় না। কিন্তু, এঁরা তাঁদের অভিনয়ক্ষমতা দিয়ে চরিত্রকে এমন এক মাত্রায় নিয়ে যান, যা থেকে পর্দায় তাঁদের উপস্থিতি একটা প্রাধান্য আদায় করে নেয়। আবার, অভিনয়ের সঙ্গে যাঁদের থাকে নাচ-গানের দক্ষতা, তাঁরা বিশেষভাবে গেঁথে যান আমাদের মনে। এরকমই একজন শিল্পী রুমা গুহঠাকুরতা, যাঁর অভিনয় না গান, কোনটাকে বেশি মনে রাখব, তা ঠিক করা বেশ কষ্টকর। সঙ্গে নৃত্যক্ষমতা। এরকম বহুমুখী প্রতিভাধর হয়ে ওঠার কারণ জানার জন্যে রুমাদেবীর জীবন-পর্যটনে একবার চোখ রাখা দরকার।

মা-বাবা নাম রেখেছিলেন ‘কমলিকা’, কিন্তু ‘রুমা’ নামের আড়ালে তা চাপা পড়ে গেল। যাবেই তো। সে নামটা যে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া! রুমার মা সতীদেবী ছিলেন সেকালের এক প্রখ্যাত গায়িকা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যতম বরেণ্য শিল্পী। গেয়েছেন রেকর্ড-রেডিও-চলচ্চিত্রে। অভিনয়ও করেছেন। রবীন্দ্রস্নেহধন্য সতীদেবী গান শিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে। কাজেই মায়ের সুবাদেই ছোট্ট রুমার রবীন্দ্র-সান্নিধ্যলাভ এবং সেই সূত্রেই ওই নামকরণ।

১৯৩৪ সালের ২১ নভেম্বর যশোরের জমিদারবংশে জন্ম রুমা দেবীর। ছোট থেকেই শিক্ষা ও সঙ্গীতের পরিবেশে বেড়ে ওঠা। মা তো বটেই, বাবা সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষ পেশায় সাংবাদিক হলেও, গান-বাজনা পাগল ছিলেন। মায়ের কাছেই রুমার প্রথম গান শেখা। খুব ছোটবয়স থেকেই কলকাতায়। সতী দেবী বাড়িতে ‘স্বরবিতান’ নামে গানের ইস্কুল খুলেছিলেন। নামটি রুমার বাবার দেওয়া। এভাবে শুরু থেকেই রুমার সঙ্গীত-মন ও কান তৈরি হতে লাগল। ইস্কুলে প্রধানত শেখানো হতো রবীন্দ্রনাথের গান। নিয়মিত রিহার্সাল চলত। রুমা সেখানে অন্যতম ছাত্রী। কোনও ফাঁকি বরদাস্ত নয়। সতী দেবী এ ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ কড়া। মেয়ে বলে রুমার কোনও বিশেষ ছাড়ের প্রশ্নই নেই। সবাইয়ের মতো নিষ্ঠা ও পরিশ্রম চাই। এভাবেই শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে সঙ্গীত প্রবেশ করতে লাগল রুমার অন্তরে। 


১৯৪১ সালে বিশ্বযুদ্ধের অশান্ত সময়ে মায়ের সঙ্গে রুমা কলকাতা ছেড়ে লাহোরে তাঁর বড়মাসির বাড়িতে চলে গেলেন। লাহোর রেডিওতে গাইতে লাগলেন সতী দেবী। সেই গান শুনে, প্রখ্যাত ইম্প্রেসারিও হরেন ঘোষ তাঁকে একটি চিঠি পাঠালেন। এই সেই হরেন ঘোষ, যিনি ভারতের প্রথম ইম্প্রেসারিও হিসেবে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতকে আলোকিত করেছিলেন অনেক অসামান্য প্রতিভাকে প্রকাশ্যে এনে, যাঁদের মধ্যে উজ্জ্বলতম নৃত্যাচার্য উদয়শংকর। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলকাতার বুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় হরেন ঘোষকে। সেদিনের সেই চিঠিতে সতী দেবীকে আলমোড়ায় উদয়শংকরের নৃত্য-অ্যাকাডেমিতে গায়িকা হিসেবে যোগ দেবার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন হরেনবাবু। পত্রপাঠ মেয়ে রুমাকে নিয়ে সেখানে চলে গেলেন সতী দেবী। প্রতিভা-বিকাশের প্রাথমিক সোপান তৈরি হয়ে গেল রুমার। শিখতে শুরু করলেন নাচ।   

উদয়শংকর তো রয়েছেনই, তার সঙ্গে শান্তি বর্ধন, অম্বা সিং, সিমকি, জোহরাবাঈ, নাম্বুদ্রিপাদ, রবিশংকর, হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, বাবা আলাউদ্দিন খাঁ, অমলাশংকর, শচীনশংকর প্রমুখের মতো রত্নের সান্নিধ্যে ও শিক্ষার পরিবেশে গড়ে উঠতে লাগল রুমার নাচ ও গানের শক্তপোক্ত ভিত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চলল নাচের প্রদর্শন। পরবর্তীকালে বেশকিছু ছবিতে রুমা গুহ ঠাকুরতার নৃত্য নিদর্শনের কারণ এখান থেকেই পরিষ্কার। দেখা যাচ্ছে, অ্যাকাডেমিতে একদিকে যেমন ছোট থেকেই তিনি শিল্পকলার নানা ক্ষেত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, তেমনি হয়েছে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ দেখার অভিজ্ঞতাও। যার ফলে, অনুমান করাই যায়, সেই সময় থেকেই রুমার ভেতরে তৈরি হয়েছিল এক সামাজিক সচেতনতা। পরবর্তীকালে তাঁর বেশকিছু কর্মকাণ্ডে আমরা পরিচয় পাই সেই চিন্তাধারার। 



নৃত্যশিক্ষার বুনিয়াদ এতটাই শক্ত হল, ওই সময়েই রুমা কম্পোজ় করলেন একটি নৃত্যনাট্য। তখন উদয়শংকরের প্রথম সন্তান আনন্দশংকর জন্মেছেন কয়েকদিন হল। তাঁরই নামে নৃত্যনাট্যের নাম হলো‒ ‘আনন্দম্’। রুমা এই কাণ্ডটি যখন ঘটালেন, তখন তাঁর বয়স নয়! সহজাত প্রতিভা বোধহয় একেই বলে। অ্যাকাডেমি বিভিন্ন জায়গায় শো করতে যেত। সেখানে মঞ্চস্থ হত ‘আনন্দম’। এরকমই আমদাবাদের একটি অনুষ্ঠানে যা ঘটল, রুমার জীবন মোড় নিল আর এক দুনিয়ায় –পর্দায় অভিনয়। 

ওই অনুষ্ঠানে প্রথমে ‘আনন্দম’-এ নাচলেন রুমা। তারপর, সুমিত্রানন্দন পন্থের নাচের কম্পোজ়িশনের সঙ্গে গাইলেন গান। দর্শকাসনে ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা ও ‘বম্বে টকিজ়’-এর কর্ণধার দেবিকারানি। রুমাকে পছন্দ হয়ে গেল তাঁর। ফলে, গান-নাচের পর এসে গেল অভিনয়ের সুযোগও।

১৯৪৪ সালে অমিয় চক্রবর্তী পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘জোয়ার ভাটা’-য় একটি নাচের দৃশ্যে প্রথমবার পর্দায় দেখা গেল দশ বছরের রুমা ঘোষকে। দেবিকারানির উদ্যোগেই এটা সম্ভব হল। প্রসঙ্গত, এই ছবিতেই প্রথমবার দেখা গিয়েছিল দীলিপকুমারকেও। এরপর, ‘মশাল’ (১৯৫০), ‘অফসর’ (১৯৫০), ‘রাগরং’ (১৯৫২) ছবিগুলোতেও বিভিন্ন ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেন রুমা। এভাবেই তাঁর মুম্বইয়ের জীবন শুরু হল। এর কিছুদিন আগেই আলমোড়া থেকে মেয়েকে নিয়ে মুম্বই এসেছেন সতী দেবী। হিন্দি ছবিতে গাইছেন— অল্পসল্প অভিনয়ও করছেন পৃথ্বীরাজ কাপুরের ‘পৃথ্বী থিয়েটার’-এ। আর এরকম আবহাওয়ায় বিকশিত হচ্ছেন কন্যা রুমা।

এসবের পাশাপাশি, সেই কলকাতায় থাকার সময় থেকেই বিভিন্ন ইস্কুলে পড়াশুনো চলেছে রুমার। কলকাতার লরেটো কনভেন্ট, গোখেল মেমোরিয়াল হয়ে, লাহোরের সেক্রেড হার্ট স্কুলে। এরপর মুম্বইয়ে এসে সেন্ট মেরিজ় কনভেন্ট। যে পরিবারে জন্মেছিলেন রুমা, তার আঁচেই তো শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ স্বাভাবিক ছন্দে ঘটবে এবং তাতে থাকবে প্রতিভার ছোঁয়া। তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেন— দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সাহানা দেবী, কনক বিশ্বাস, সুপ্রভা রায় (সুকুমার-পত্নী), বিজয়া দাশ (সত্যজিৎ-ঘরণী), সত্যজিৎ রায়ের মতো আরও কেউ কেউ।


ফিরে আসি মুম্বইয়ের জীবনে। ১৯৫০ সালে ‘বম্বে টকিজ়’ তৈরি করল একটি ডাবল ভার্শন ছবি। হিন্দিতে ‘রজনী’ বাংলায় ‘সমর’। বঙ্কিমচন্দ্রের কাহিনি। পরিচালক নীতিন বসু। শচীন দেববর্মণের অনবদ্য সুর রচনায় গানে গানে মাত হয়ে গেল ছবিটি, যার মধ্যে কোরাসে গাওয়া, ‘সুন্দরী লো সুন্দরী / দল বেঁধে আয় গান করি…’ (কথা- মোহিনী চৌধুরী) জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছল। সমবেতকণ্ঠে অন্যতম ছিলেন কিশোরকুমার এবং এই গানের সঙ্গে নাচের দৃশ্যে নর্তকীদের মধ্যে একজন রুমা ঘোষ। এই সংযোগই পরিচয় ঘটাল কিশোর-রুমার। তা থেকেই প্রণয় ও অবশেষে পরিণয় ১৯৫১ সালে। পরের বছর জন্ম হল পুত্র অমিতকুমারের।

কিশোরকুমার পরিবারের একজন হয়ে রুমা গঙ্গোপাধ্যায় অনায়াসে জড়িয়ে পড়তে পারতেন মুম্বইয়ের ফিল্মজগতের আলো ঝলমলে পরিবেশে। নাচ, গান, অভিনয় সবেতেই পারদর্শী তিনি। সুযোগও ছিল যথেষ্ট। অসুবিধে কিছুই ছিল না। কিন্তু তা তিনি করলেন না। আপন চিন্তাধারায় প্রকাশ করলেন নিজেকে। শুরু থেকেই তাঁর মধ্যে প্রগতিবাদী ভাবনা কাজ করত। মুম্বই এসেই সতী দেবী মেয়েকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বম্বে আইপিটিএ-তে। জনজাগরণের গান, নাটক, কবিতার সঙ্গে তখন থেকেই পরিচিত হলেন রুমা। তারপর আইপিটিএ-এর কার্যকলাপ ক্রমে স্তিমিত হয়ে পড়তে লাগল। 

কিন্তু রুমার অন্তরে ছিল এই ধরনের সাংস্কৃতিক ভাবনা। এবার, সেই চিন্তাধারা নিয়েই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন ‘মানুষের গান’। তখন মুম্বইতে রয়েছেন অনেক প্রতিভাবান গীতিকার-সুরকার, গায়ক-গায়িকা। তাঁদের অনেকের মধ্যেই কাজ করছে প্রগতিবাদী চেতনা। যেমন শৈলেন্দ্র, প্রেম ধওয়ান, ক্যায়ফি আজ়মি, সলিল চৌধুরী, কানু ঘোষ প্রমুখ। এঁদের সবাইকে নিয়ে রুমাদেবীর উদ্যোগে ১৯৫৬ সালে গড়ে উঠল— ‘বম্বে ইয়ুথ কয়্যার’। বহুমুখী প্রতিভাধর হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তখন মুম্বাইতে। তিনিও এগিয়ে এলেন। নিজেরাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘বম্বে ইয়ুথ কয়্যার’ পরিবেশন করতে লাগল জাগরনের গান। 

প্রথম অনুষ্ঠান হল ‘ভারতীয় বিদ্যা ভবন’-এ। তখন মুম্বইতে কাজের সুবাদে গিয়েছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র। তাঁরাও গাইলেন সেই অনুষ্ঠানে। শুরুতেই মানুষের মনে সাড়া ফেলে দিল কয়্যার। এদের কিছু গান ছিল এইরকম— ‘ইয়ে ওয়াক্ত কি আওয়াজ হ্যায়, মিলকে চলো…’ (কথা- প্রেম ধওয়ান, সুর- কানু ঘোষ), ‘সরফরোশি কি তামান্না…’ (কথা- রামচন্দ্র বিসমিল, সুর- প্রচলিত), ‘তরুণ অরুণ সে রঙ্গিত ধরণী…’ (কথা ও সুর- শৈলেন্দ্র) ইত্যাদি। লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত কুমার, মান্না দে, মুকেশের মতো তারকা শিল্পীরাও মাঝেমাঝেই গাইতেন কয়্যারের সঙ্গে। কিছু রেকর্ডও বেরিয়েছিল ‘বম্বে ইয়ুথ কয়্যার’-এর। রেডিওতেও গাইতেন তাঁরা। গ্ল্যামারাস সিনেমার জগতকে প্রাধান্য না দিয়ে, মানুষের মধ্যে গিয়ে এই গান করার নিদর্শন, প্রথম থেকেই রুমাদেবীকে ব্যতিক্রমী করে তোলে।

বিবাহবিচ্ছেদের কারণে ১৯৫৮ সালে রুমা চলে এলেন কলকাতায়। বম্বে ইয়ুথ কয়্যার-ও বন্ধ হয় গেল। দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন আর এক শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান পরিবারের গুণী মানুষ অরূপ গুহঠাকুরতাকে। এঁর যেমন ছিল সংগীতজ্ঞান, তেমনই চলচ্চিত্রটাও বুঝতেন। পরিচালনা করেছিলেন দু’টি ছবি— ‘বেনারসী’ (১৯৬২) ও ‘পঞ্চশর’ (১৯৬৮)। দু’টিতেই নায়িকার ভূমিকায় দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন রুমা এবং গানও গেয়েছেন। ‘বেনারসী’ ছবিতে উস্তাদ আলী আকবর খাঁ-র সুরে দু’টি ঠুংরি গানে অবাক করে দিয়েছিলেন তিনি। কী সাবলীলতায় যে ঠুংরি পরিবেশন হতে পারে, তা রুমার কণ্ঠে গানদু’টো শুনলে বোঝা যায়। 

Ruma Guha Thakurata Bengali singer and Filmstar
পরমপ্রিয় ‘মানিকমামা’-র সঙ্গে

আমরা জানি, প্রথমদিকে মা সতী দেবী ও মুম্বইয়ে থাকার সময় কিছুদিন এক ওস্তাদজির কাছে তালিম নেওয়া ছাড়া রুমার সেই অর্থে প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষা নিয়ম করে হয়নি। কিন্তু, জন্মগত সঙ্গীতপ্রতিভায় ছিলেন ঠাসা। তাই বোধহয় যখনই যে গান গেয়েছেন, তা থেকে সম্পূর্ণ এক নিজস্ব সাঙ্গীতিক ধরনের প্রকাশ ঘটেছে। ‘বেনারসী’ ছবির ঠুংরিদু’টো শুনলে তা বোঝা যায়। রুমা গুহ ঠাকুরতার কণ্ঠ প্রক্ষেপণও ছিল নিজস্বতায় ভরা। অল্প চাপা, বিশেষ ধরনের মিষ্টতা, রোম্যান্টিক অথচ উদাত্ত। হিন্দিতে তাঁর গান তেমন শোনা না গেলেও বাংলায় আমরা বৈচিত্র্যে ভরা সঙ্গীতশিল্পী রুমা গুহঠাকুরতাকে পাই নানা ধরনের গানে।

Ruma Guha Thakurata Bengali singer and Filmstar
তাঁর রূপ এবং কণ্ঠস্বর দুইই ছিল সাধারণের চেয়ে একেবারে আলাদা, স্বতন্ত্র

রুমার অভিনয় প্রসঙ্গে যাবার আগে দেখা যাক গানের দিকটি, যেখানে অভিনয়ও যুক্ত অনেক ক্ষেত্রে। আবার, নন-ফিল্ম গানও আছে। প্রথমেই আসা যাক রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে। রুমা গুহঠাকুরতার কণ্ঠচলনে অনেক ক্ষেত্রে ধরা পড়ত এক ধরনের রহস্যময়তা, যার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’ (১৯৬১) ছবির ‘মণিহারা’-এ, যখন কণিকা মজুমদারের লিপে রুমা গাইলেন রবীন্দ্রনাথের ‘বাজে করুণ সুরে…।’ অসামান্য দৃশ্যবিন্যাস ও কাহিনির গতিপথের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গাওয়া গানটি যেন গা ছমছমানি ধরিয়ে দেয়। ‘যদি জানতেম’ (১৯৭৪) ছবিতে ‘সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি’, এমনভাবে গাওয়া যে তা আদর্শ সংলাপে পর্যবসিত হয়ে গেছে বলে মনে হয়। আবার ‘লুকোচুরি’ ছবিতে (১৯৫৮) কিশোরকুমারের সঙ্গে গাওয়া ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী…’ আদ্যন্ত রোম্যান্টিক পরিবেশন। 

এছাড়াও বলতে হয়, ‘শুভা ও দেবতার গ্রাস’ (১৯৬৪) ছবিতে দ্বিতীয় অংশে ‘আমার বিচার তুমি কর…’, বর্ণালী-তে (১৯৬৩) ‘যখন ভাঙল মিলন মেলা…’, ‘পঞ্চশর’ (১৯৬৮) ছবিতে ‘মম চিত্তে…’ এবং দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে ডুয়েট ‘তোমরা যা বল তাই বল…’ , ‘নির্জন সৈকতে’ (১৯৬৩) ছবির ‘দেখ দেখ দেখ শুকতারা আঁখি মেলি চায়…’,  ‘বাক্সবদল’ (১৯৬৫) ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘মায়ার খেলা’-র কয়েকটি গান ইত্যাদি। এর মধ্যে কোনওটি অভিনয়-সহ, আবার কোনওটি নেপথ্য কণ্ঠে।

রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও অন্য অনেক গান যা গেয়েছেন রুমা, তাঁর প্রত্যেকটা থেকে প্রতিফলিত নিজস্ব নাটকীয়তা। ‘পলাতক’ (১৯৬৩) ছবিতে ‘চিনিতে পারিনি বঁধূ…’ গানের (কথা- মুকুল দত্ত) সুররচনায় সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কীর্তনের চলন একটু পাল্টে যে অসামান্য মুনশিয়ানায় ঝুমুরওয়ালীদের নাচের ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে দেন, তা রুমা দেবীর নৃত্যভঙ্গিমা ও গায়নভঙ্গির সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায়, যা কাহিনি অনুযায়ী অর্থবহতাকে স্পষ্ট করে তোলে দৃশ্যবিন্যাসে। একই সুরকারের সুরে ‘লুকোচুরি’-তে কিশোরকুমারের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ‘এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায়…’-এর মতো চিরসবুজ গান কি ভোলা যায়? 

আবার ১৯৬৭ সালে ‘আশিতে আসিও না’ ছবিতে মান্না দে-র সঙ্গে গাইলেন কমেডি-নির্ভর গান। পুরুষকণ্ঠ যত স্বপ্নময় রোম্যান্টিক কথা বলছেন, নারীকণ্ঠ তত বাস্তবধর্মী মজার উত্তর দিচ্ছেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিপে মান্না-কণ্ঠে গানটা শুরু হচ্ছে এইভাবে— ‘তুমি আকাশ এখন যদি হতে / আমি বলাকার মতো পাখা মেলতাম…’। উত্তরে নায়িকা রুমা গাইছেন, ‘তুমি যদি ময়দা হতে / জলখাবারে লুচি বেলতাম…।’ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও গোপেন মল্লিকের সুরে এক অনবদ্য পরিবেশন! 

এই গানটিকে নিয়ে ঘটেছিল এক অভিনব ঘটনা! সিনেমায় মহিলা-কণ্ঠটি রুমা গুহঠাকুরতার, কিন্তু রেকর্ডে নির্মলা মিশ্রর। কেন এরকম? তখন রুমা ছিলেন ‘মেগাফোন’ রেকর্ড- কোম্পানির চুক্তিবদ্ধ শিল্পী। কিন্তু গানটির রেকর্ড বেরিয়েছিল ‘এইচএমভি’ থেকে। তাই ওই কোম্পানি থেকে আইনত রুমার কণ্ঠে রেকর্ড বেরনোর উপায় ছিল না। তাই নিজেদের অন্যতম চুক্তিবদ্ধ শিল্পী নির্মলা মিশ্রকে দিয়ে মহিলা-কণ্ঠের অংশটি রেকর্ড করাল এইচএমভি। এই কারণেই সিনেমায় রুমা— রেকর্ডে নির্মলা। ১৯৬ সালে রুমা গুহঠাকুরতা এইচএমভি-র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। 

Ruma Guha Thakurata Bengali singer and Filmstar
রুমা গুহঠাকুরতার কণ্ঠচলনে ধরা পড়ত এক ধরনের রহস্যময়তা

তার পরের বছরেই পুজোর রেকর্ডে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও ভূপেন হাজারিকার সুরে তাঁর গাওয়া, ‘একখানা মেঘ ভেসে এল আকাশে…’ দারুণ জনপ্রিয় হয়। তাঁর আরও কিছু বাংলা ছবির গানের কথা উল্লেখ করা যায়। ‘নিশিকন্যা’-য় (১৯৭৩) সুধীন দাশগুপ্তের কথায় ও সুরে ‘ভেঙে যাবে ঠুনকো কাচের চুড়ি…’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-তে (১৯৬৭) মান্না দে-র সঙ্গে ‘শুক বলে সারি রে তোর…’ (কথা- গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর- অনিল বাগচি), গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, নীতা সেনের সুরে ‘রসময়ীর রসিকতা’ (১৯৮২) ছবিতে কমেডিধর্মী ‘ঠাকুরপো একটুখানি…’ ইত্যাদি আরও বেশকিছু। এটুকু উল্লেখেই বোঝা যায় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে রুমা গুহঠাকুরতা যে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন বাংলা গানের জগতে। 

হিন্দি গানে তাঁকে খুব বেশি পাওয়া না গেলেও, কিছু তো বলতেই হয়। সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ (১৯৭৭)-তে রুমাদেবীর গ্রুপ ‘ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার’ গান গেয়েছিল। বিরজু মহারাজের তালিমে এ ছবির ‘হিন্দোলা ঝুলে শ্যাম’ গানটিতে মুখ্য কণ্ঠ ছিল রুমার। ১৯৭৭ সালে অরুণাচল প্রদেশ সরকারের তৈরি ‘মেরা ধরম মেরি মা’ ছবিতে দু’টি গানের একটি গেয়েছিলেন ভূপেন হাজারিকা ও রুমা গুহঠাকুরতা এবং আর একটিতে এই দু’জনের সঙ্গে ইলা বসুর কণ্ঠ সংযোজিত হয়েছিল। সঙ্গীত পরিচালক ভূপেন হাজারিকা। গানের কথা অনেক হল, এবার আসা যাক চিত্রাভিনেত্রী রুমা গুহঠাকুরতার কথায়।

রুমার প্রথম বাংলা ছবি ‘সমর’ (১৯৫০)। এরপর ১৯৫৮ সালে কলকাতায় এসে ১৯৫৯ সালে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে নায়িকা হলেন ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবিতে। এরকম একটি কমেডি ছবিতে, ওইরকম তুখোড় কমেডিয়ানের বিপরীতে যে অসাধারণ মাপ ও টাইমিং বজায় রেখে অভিনয় করেছেন রুমাদেবী, তা থেকেই তাঁর অভিনয়ক্ষমতার জাত চেনা যায়। অভিনয় জগতে কিন্তু তিনি সবসময় তাঁর গানের সুবিধাকে কাজে লাগাননি। অনেক ছবিতেই তাঁর মুখে কোনও গান নেই। এখান থেকেই রুমা গুহঠাকুরতা চিত্রাভিনেত্রী হিসেবে আদায় করে নেন আলাদা মর্যাদা। 

তাঁর ‘মানিকমামা’-র (সত্যজিৎ রায়) দু’টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ‘অভিযান’ (১৯৬২) ও ‘গণশত্রু’ (১৯৯০)। সময়ের বিস্তর ফারাক অনুযায়ী বয়সেরও অনেকটাই তফাৎ ঘটে গেছে দু’টি ছবিতে। সেই অনুসারেই চরিত্রচিত্রণ ও তার প্রতি অভিনেত্রীর সুবিচার। ‘অভিযান’-এ অন্তর্মুখী, শিক্ষিত, আত্মবিশ্বাসী যুবতী। ‘গণশত্রু’-তে আটপৌরে গৃহবধূ, কিন্তু, যাঁর নিজস্ব বোধবুদ্ধি স্বচ্ছ। যুক্তি ও সত্যকে আশ্রয় করে চলা আদর্শবাদী ডাক্তার-স্বামীকে তিনি অন্তর থেকে সমর্থন করেন। রুমাদেবীর যথার্থ অভিনয়ে চরিত্রদু’টি স্পষ্টতা পায়। 

Ruma Guha Thakurata Bengali singer and Filmstar
নায়িকা হিসেবে সবসময় নিজের গায়িকা পরিচয় ব্যবহার করেননি রুমা

এছাড়া তাঁর অভিনীত যেসব ছবির কথা আরও বলতে হয়, তার মধ্যে ‘গঙ্গা’ (১৯৬০), ‘কিনু গোয়ালার গলি’ (১৯৬৪), ‘বাঘিনী’ (১৯৬৮), ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’ (১৯৭৪), ‘দাদার কীর্তি’ (১৯৮০), ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ (১৯৮২), ’হুইল চেয়ার’ (১৯৯৪) ইত্যাদি প্রায় ৬০/৭০ টি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। প্রসঙ্গত, ঋত্বিক ঘটক তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে প্রথমে মুখ্য চরিত্রে ভেবেছিলেন রুমার কথা। কিন্তু তখন তিনি ব্যস্ত রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’ ছবির শুটিংয়ে। তাই ‘নীতা’ আর তাঁর করা হয়নি। অভিনেত্রী রুমা গুহঠাকুরতা তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তো অবশ্যই, যেখানে আছে বৈচিত্র্যের বিন্যাস। 

সব সত্ত্বেও, তাঁকে যেন সেরা মনে হয়, যেখানে তিনি শান্ত, সৌম্য, স্নেহময়ী জননী, যাঁর একটা চাপা ব্যক্তিত্ব আছে। সবমিলিয়ে এক বিষাদপ্রতিমা, দর্শকমনে যা নাড়া দিয়ে যায়। তাঁকে ভীষণ আপন মনে হয় সেইসব চরিত্রে। ‘ক্ষণিকের অতিথি’ (১৯৬৯), ‘নির্জন সৈকতে’ (১৯৬৩), ‘আরোগ্য নিকেতন’ (১৯৬৯)— এই তিনটি ছবি যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর মধ্যে দ্বিতীয় ছবিতে অভিনেত্রী হিসেবে রুমাদেবী জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ছায়া দেবী, ভারতী দেবী ও রেণুকা রায়ের সঙ্গে। এখান থেকেই প্রমাণিত, অভিনেত্রী হিসেবে তিনি কোন জাতের ছিলেন। তাঁর গান ও অভিনয়কে আলাদাভাবে মর্যাদা দিয়েছেন মানুষ। অর্থাৎ, দু’ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতিভার প্রকাশ পৃথকভাবে সম্মান আদায় করে নিতে পেরেছে, যা খুব কম শিল্পীর ক্ষেত্রেই আমরা দেখি।

সব সত্ত্বেও বলতে হয়, গানই ছিল রুমাদেবীর কাছে প্রধান। শুধু গান বললেই হবে না— জনজাগরণের গান। এ কারণেই মুম্বই থেকে কলকাতায় এসেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন  ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’। এ ব্যাপারে সলিল চৌধুরীর দারুণ উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা ছিল। রেকর্ড-ছবির জগতে নিয়মিত শিল্পী হয়েও রুমাদেবী ইয়ুথ কয়্যারকে বুকে আঁকড়ে নিয়ে চললেন। তাকে ক্রমশ বড় আকার দিলেন। ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। প্রতি বছর পুজোর সময়ে তাদের রেকর্ড বেরতো গ্রমাফোন কোম্পানি থেকে। 

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কয়্যারের গান ছিল অন্যতম আকর্ষণ। কতরকম গান যে কয়্যারের মাধ্যমে আজও মানুষের মনে  গেঁথে আছে!— ‘এক সাথে চলেছি আজ পথে…’, ‘ওরা জীবনের গান গাইতে দেয় না…,’ ‘ঝঞ্ঝা ঝড় মৃত্যু দুর্বিপাক…’, ‘ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম…’, ‘পথে এবার নামো সাথী…’, ‘একদিন সূর্যের ভোর…’, (উই শ্যাল ওভারকাম অনুসরনে), ‘এসো মুক্ত করো…’ ইত্যাদি আরও অজস্র। সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ইত্যাদি অনেকের গান তাঁরা গাইলেও, কয়্যারের বেশিরভাগ গানের গীতিকার ছিলেন শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। 

https://www.youtube.com/watch?v=qnYHJzV3R2I
‘বিস্তীর্ণ দুপারে’-র সেই অমোঘ জুটি যাকে আমৃত্যু হৃদয়ে রাখবে বাঙালি

বিদেশে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত গায়ক হ্যারি বেলাফন্টের সঙ্গে দেখা হয়েছিল রুমা গুহঠাকুরতার। গান ও কথায় এক অসাধারণ মুহূর্ত কাটানোর কথা পরবর্তীকালে কয়েকবার বলেছেন রুমাদেবী। বেলাফন্টের একটি বিখ্যাত গানের অনুসরনে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি গান রেকর্ডে গেয়েছিল ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার- ‘সাগর নদী কত দেখেছি দেশ…’। তবে, যে গানের কথা না বললে সবকিছুই অর্থহীন, সেটি হল- ‘বিস্তীর্ণ দুপারে… ও গঙ্গা বইছ কেন…।’ পল্ রোবসনের ‘Oh my orphan River’- এর অনুসরনে অহমিয়া ভাষায় গানটি লেখেন ও সুর করেন ভূপেন হাজারিকা। বাংলা রূপান্তর শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের। 

ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার, রুমা গুহঠাকুরতা ও এই গান— মিশে আছে একে অপরের সঙ্গে। কোনও অনুষ্ঠানে নিস্তার ছিল না ‘ও গঙ্গা বইছ কেন’ না-গেয়ে। কয়্যারের গানে সমবেত কণ্ঠের অসামান্য বিন্যাসের মধ্যে রুমাদেবী মাঝেমাঝেই ব্যবহার করতেন তাঁর একক কণ্ঠ। এক্ষেত্রে সবমিলিয়ে তৈরি হত এক অপূর্ব হারমনি। এই ধরনের গানে রুমা দেবীর কণ্ঠ-প্রক্ষেপণও ছিল যথাযথ। কয়্যারের নানারকম পরিবেশনের মধ্যে আছে বাংলার কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানগুলিও। একবার পুজোয় ‘বান এসেছে…’ শিরোনামে একটি লং প্লেয়িং রেকর্ডে বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গানগুলি গেয়েছিল ‘ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার’।

রুমা গুহঠাকুরতার ট্রেনিং দেওয়ার পদ্ধতি কেমন ছিল, সে বিষয়ে একবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় যে বিশাল শান্তি মিছিল হয়েছিল, তার মূল স্কোয়াডে গান গাইবার সৌভাগ্য হয়েছিল সেবার। মিছিলের প্রায় একমাস আগে থেকে সপ্তাহে কয়েকদিন ধরে গানের রিহার্সাল হত মৌলালি যুবকেন্দ্রে। তিনটি গান ঠিক হয়েছিল গাইবার জন্যে— ‘এসো মুক্ত করো…’, ‘একসাথে চলেছি আজ পথে…’ এবং ‘একদিন সূর্যের ভোর…’। 

প্রথমদিন রিহার্সালে গিয়েই হাতে এসে গেল তিনটি গানের সাইক্লোস্টাইল করা সম্পূর্ণ বাণীরূপ। যুবকেন্দ্রে প্রেক্ষাগৃহের দর্শকাসনে বসলাম। সেখানে হলভর্তি করে বসে আছেন ইউথ কয়্যারের ছেলেমেয়ে-সহ কলকাতা ও মফসসল থেকে আসা অজস্র ছেলেমেয়ে। মঞ্চ থেকে গান তিনটি শেখাচ্ছেন রুমা গুহঠাকুরতা ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পী মায়া সেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওই তিনটি গানের ট্রেনিং প্রায় দশ-বারো দিন ধরে করিয়েছিলেন তাঁরা। মুখ্য ভুমিকা রুমাদিরই ছিল। কোনও বিরক্তি নেই। গানগুলো যতক্ষণ না একেবারে ঠিক পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে ততক্ষণ অফুরন্ত উৎসাহ ও শক্তি দিয়ে শিখিয়ে গেছেন তিনি। ওই কদিনের রিহার্সালে মাঝেমাঝেই এসেছেন সলিল চৌধুরী, সবিতাব্রত দত্ত, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অংশুমান রায়ের মতো সঙ্গীত ব্যাক্তিত্বেরা। সে এক চিরভাস্বর অভিজ্ঞতা! 

Ruma Guha Thakurata Bengali singer and Filmstar
তাঁকে যেন সেরা মনে হয়, যে চরিত্রে তিনি শান্ত, সৌম্য, স্নেহময়ী জননী, যাঁর একটা চাপা ব্যক্তিত্ব আছে

নির্দিষ্ট দিনে ধর্মতলা মেট্রো সিনেমার সামনে থেকে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড অবধি রুমা গুহঠাকুরতার নেতৃত্বে মিছিলের পুরোভাগে আমরা ওই গান তিনটি গাইতে গাইতে গেলাম। ছিলেন সঙ্গীত-সাহিত্য-অভিনয়জগতসহ অনেক ক্ষেত্রের প্রথিতযশারা। এ উন্মাদনার পরিমাপ করা যায় না। ব্রিগেডে পৌঁছে খাবারের প্যাকেট পেয়ে, তার সদ্ব্যবহার করে যখন রুমাদিকে বললাম— দিদি যাচ্ছি এবার? তিনি বললেন, ‘খেয়েছ বাবা?’এই স্নেহস্বর কোনওদিন ভুলব না। কে আমি? ক’দিন মাত্র আমায় হয়তো দেখেছেন ভিড়ের মধ্যে। খুবই অল্প কথাবার্তা হয়েছে। তাইতেই অত বড়মাপের মানুষটির এই আন্তরিকতা দেখানো যথার্থ শিল্পীর মহৎ হৃদয়েরই পরিচায়ক। তারপর বারকয়েক রুমাদেবীর সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে বিভিন্ন কারণে, প্রত্যেকবারই তাঁকে ভীষণ কাছের মনে হয়েছে। দূরে থাকা সেলিব্রিটি কখনওই ভাবতে পারিনি তাঁকে।

গানে, অভিনয়ে চিরকালের শিল্পী হয়ে থাকা রুমা গুহঠাকুরতার অন্তর ছেয়ে ছিল কিন্তু তাঁর তৈরি কয়্যার। আইপিটিএ-র সঙ্গীতধারার প্রবহমানতাকে সার্থকভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে ‘ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার’। একদা এক সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমার তিনটি সন্তান। দুই পুত্র এক কন্যা। অমিত, অয়ন ও শ্রমণা। অনেকে বলেন ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার আমার চতুর্থ সন্তান। কথাটা মিথ্যে নয়। আমার জীবনের ‘ধ্রুবতারা’ এই কয়্যার। ‘মানসকন্যা’ও বলা যায়। আমার সত্তা, স্বপ্ন, আকাঙ্খা সবকিছু জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। একসময় আমি নিয়মিত সিনেমায় অভিনয় করেছি, অভিনেত্রী হবার বাসনাও হয়তো লালন করেছি মনে মনে। কিন্তু একে বাদ দিয়ে নয়। বলেছি তো, ‘কয়্যার’ আমার ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন।… আমার কয়্যারের মূলমন্ত্র দেশবিদেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলা। জাত নয়, ধর্ম নয়, মানবতাই বড় কথা।’

Ruma Guha Thakurata Bengali singer and Filmstar
তিন সন্তান – (বাঁ দিক থেকে) অয়ন, অমিত ও শ্রমণা

জীবনের শেষ দিনগুলি পর্যন্ত তিনি এই বিশ্বাসে বাঁচতেন যে তিনি একদিন থাকবেন না, কিন্তু ইউথ কয়্যার অবশ্যই থাকবে। তাঁর জীবনের উপান্তে অডিও ভিস্যুয়াল মাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে দেখা গিয়েছিল, একথা বলতে বলতে রুমা তাঁর ডানহাতের বজ্রমুষ্টি ওপরদিকে তুলে ধরেছিলেন। স্বপ্ন দিয়ে গড়া ক্যালকাটা ইউথ কয়্যারের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে এমনই ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাস। স্মরণধর্মীতার গতানুগতিক আড়ম্বর আর রুপোলি পর্দার গ্ল্যামার ভুলে আমরা যদি বেশি করে মনে রাখি তাঁর মানবতাবাদী দরদী শিল্পীমনটিকে, তবেই দেওয়া হবে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ্য।